Saturday 30 June 2012

ছেলেটা


রোজকার মত বাইরে মোরগ ডাকছে, মোড়ের মাথার মসজিদটায় আজান দিচ্ছে। রোজকার মত ঠিক সেই সময়ে সুমনের ঘুমটা ভেঙে গেল।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ার অভ্যেস। ঘড়ির কাঁটা যেই ৬টার ঘর ছুঁই ছুঁই, সুমন অমনি তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। তারপর ৭টার মধ্যে প্রাত্যহিক যোগ ব্যায়াম সেরে চান করে একদম ফিটফাট। তাতে আর কিছু না হক, অফিস যাওয়ার আগে অনেকটা সময় ওর হাতে এসে যায়।

আজ কিন্ত ঘুম ভেঙে হাত-পা কেমন আড়ষ্ট লাগল সুমনের। বিছানা ছেড়ে ওঠা দূর-অস্ত, পাশ ফিরতেও কেমন জানি ইচ্ছে করছে না। সারা শরীরে, মনে এক অদ্ভুত অবসাদ, এক সীমাহীন আলস্য। খানিক্ষন ফুল স্পীডে চলা সীলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সুমনের চোখটা আবার বুজে এল।

ক’টা বাজে এখন? ওঠবার সময় হয়েছে নিশ্চই! নাকি বেশী সকালে ঘুম ভেঙে গেল? পায়ের দিকের দেওয়ালে একটা বড় ঘড়ি আছে। অনেক কষ্টে একটা চোখ খুলে পিটপিট করে তাকাল সুমন। ধুলোমাখা সবজে রঙের দেওয়ালটা কির’ম জানি বেশী ময়লা লাগছে।

ধুৎ! কোথায়  গেল ঘড়িটা?

খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সুমন বুঝল কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।

ঘড়িটা তো নেই!!! ডাইনের দেওয়াল, বাঁয়ের দেওয়াল – কোত্থাও নেই!

গেল কোথায়? উলটো দিকে মাথা করে শুয়েছে, না কী?

নাঃ! আর তাকিয়েও থাকা যাচ্ছে না। চোখদুটো আপনিই আবার বুজে আসল সুমনের।

---------------------------------

খালি বালতিতে কলের জল পড়ার আওয়াজ সুমনের ভারি অপছন্দ। আর ঠিক সেই আওয়াজেই দ্বিতীয়বার ঘুম ভাঙল আজ।

তার মানে পূর্নিমা চান করতে গেছে।

পূর্নিমা, মানে সুমনের স্ত্রী।

কিন্তু তার তো অনেক বেলায় চান করার অভ্যেশ! কতক্ষন ঘুমচ্ছে সুমন? স্বভাবমত পায়ের দিকের ঘড়ীটার দিকে আরেকবার তাকাল সুমন, আর তাকিয়েই মনে পড়ল “ওঃ! ওটা তো নেই!”

এবার উঠতেই হছে। এক ঝটকায় উঠে পড়ার চেষ্টা করল সুমন।

হল না। একটুও নড়তে পারল না।

“হল কি? পঙ্গু হয়ে গেলাম নাকি?”

“পূর্নিমাআআআআআআআ” – ডাক দিল সুমন। বা বলা ভাল ডাক দেওয়ার চেষ্টা করল। কারন আওয়াজ একটুও বেরল না। কিন্তু ওর তো ঠোঁট নড়ছে, জিভ নড়ছে, এমনকি কথা বলার চেষ্টা করলে কন্ঠনালীতে সেটা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে।

কিন্তু আওয়াজ? আওয়াজের কি হল?

“পূর্নিমাআআআআআআআ” – সেই একই ফল। কোন আওয়াজ নেই।

এবার একটু ভয় করছে সুমনের। ও কি বোবা হয়ে গেছে? কালা হয়ে গেছে? কি হয়েছে ওর?

আর ও এখন আছেই বা কোথায়?

--------------------------------------

বাথরুমে জলের আওয়াজ থেমেছে। পূর্নিমা আর ৫ মিনিটে বেরোবে। তারপর নিশ্চই ওর অবস্থা দেখে ডাক্তার ডাকবে। নিজেকে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করল সুমন।

আর ভাবতে লাগলো। কাল রাতে ও কোথায় শুয়েছে? অন্যদিনের মত কালকেও তো ডিনারের পর একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল পূর্নিমাকে নিয়ে। তারপর? রাস্তায় পূর্নিমার স্কুলের কোনো এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেছিল। তারপর যা হয়! খানিকক্ষণ পার্কের বেঞ্চিতে বসে ওদের ছোটবেলার স্মৃতিরোমন্থন, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে এক সাথে চা খাওয়া, বন্ধুটার আই-ফোনে ফটো তোলা-টোলা – এইসব হল। তারপর?

নিশ্চই বাড়ি ফিরেছিলাম! আর কোথায়ই বা যাবে সুমন? কিন্তু আর কিছুই মনে পড়ছে না।

রাত থেকেই শরীর খারাপ হয়নি তো? হয়ত তাই-ই কিছু মনে নেই।

পূর্নিমা এখনো বেরচ্ছে না কেন?

“পূর্নি......” নাঃ। লাভ নেই।

গলা শুকিয়ে আসছে সুমনের। এত গরম লাগছে কেন? পাখাটা তো ঠিকই ঘুরছে, তবু যেন হাওয়া গায়ে না লেগে পিছলে যাচ্ছে।

চোখ বুজে নিজের শরীরটাকে নতুন করে অনুভব করার চেষ্টা করল সুমন। হৃদপিন্ডের ধুকপুক ঠিক চলছে তো? হ্যাঁ, চলছে। নিশ্বাসের উত্তাপ পড়ছে ওপরের ঠোঁটে। তাহলে? বাকি শরীরটা কেন ওর মনের বশে নেই? সর্বশক্তি দিয়ে আরেকবার ঘাড় ঘোরানোর চেষ্টা করল সে।

হচ্ছে না।

নিজেকে বড়ো অসহায় লাগছে সুমনের। ও বেঁচে আছে তো? এটা কি বিছানা, না কি এক অদৃশ্য কফিন যার মধ্যে ওকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে?

-------------------------------------------

“শুনছো? গ্যাস ফুরিয়েছে। ইন্‌ডেনে খবর দিতে হবে” – এতক্ষণে পূর্নিমার গলা শোনা গেল। কখন জানি বাথরুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে চলে গেছে।

একবার আমার দিকে খেয়াল করেও দেখল না? অদ্ভুত মেয়ে বটে।

রান্নাঘরে ঘটাং ঘটাং শব্দ। খালি সিলিন্ডার বদলানো হচ্ছে। এই একটা কাজ পূর্নিমা কখন নিজে করেনি, সুমনকে দিয়ে করিয়ে এসেছে। আজ নিজে করছে কেন?পূর্নিমার এঘরে আসা অবধি কিছু করার নেই। মনে মনে সময় গুনতে লাগল সুমন। এক মিনিট, দু মিনিট, তিন...

সিলিন্ডার বদলানো হয়ে গেছে নিশ্চই। গরম তেলে ফোড়ন পড়ার ছ্যাক্‌ ছ্যাক্‌ শোনা জাচ্ছে।

“উফ্‌ফ্‌! ছাড়ো। কি শুরু করেছ বল তো কাল রাত থেকে?” পূর্নিমা??!! এ কার সাথে কথা বলছে?

“এই শয়তান ছেলে! ছাড়ো, রান্না করতে দাও” পূর্নিমার গলায় মিথ্যে রাগ মেশানো আদরের সুর।

সুমন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। পূর্নিমা!

“এবার ম’লে সুতো হব, তাঁতির বাড়ি জন্ম লব...” এটা তো ছেলের গলা। সেই ছেলেটা – সেই কালকের ছেলেটা। কি জানি নাম?

হাসির আওয়াজ। সাথে আরো অনেক কিছুর, যা সুমন শুনেও শুনতে চায় না।

কি করেছে ওরা? ওকে কিছু খাইয়ে দিয়েছে? সেই ফুটপাথের চা-টা? সেটাতে কিছু ছিল?

নিশ্চই তাই। আর কিছু হতে পারে না।

পুর্নিমা! উফ্‌ফ্‌! সুমন আর ভাবতে পারছে না। কি করবে ও? কোনো ওষুধ খাইয়ে দিয়ে থাকলে তার প্রভাব কাটবে নিশ্চই এক সময়।

কতক্ষণ? আর কতক্ষণ? এখনো তো নড়তে পারছে না। ওর কি হাত-পা বাঁধা আছে? বুঝতে পারছে না।

“মাআআআআআআআআআআআআআআআআআ” নিস্ফল চিৎকার করল সুমন।

ভগবান! কাল তো কিছু বুঝিনি ওদের দেখে। কান্না আসছে সুমনের। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

এ কী হল ওর? এক বছরও হয়নি ওদের বিয়ের। পূর্নিমাকে নিজেই পছন্দ করেছিল সুমন। রীতিমত ১২টা বাড়ি ঘুরে মেয়ে দেখে বাছাই করেছিল। বেশ সরল, সাধাসিধে দেখতে – ওর মনে হয়েছিল এ মেয়ে ভাল সংসারী হবে। বরকে রান্না করে খাইয়ে আনন্দ পাবে, এক গাদা উটকো দাবি থাকবে না, মা’র সাথে কোনো ঝগড়া...

“আআআআআআআহহহহহহহহ!” সুমনের সব চিন্তা ভাবনাকে ওলট পালট করে দিয়ে হঠাৎ একটা শব্দ – একটা বীভৎশ শব্দ। যেন এক হাজার শাঁখ, কাঁশর, ঘন্টা এক সাথে বেজে উঠেছে সুমনের মাথার ভেতর। মাথার প্রতিটা শীরা-উপশীরা উপড়ে বেরিয়ে আসছে বাইরে। অদ্ভুতভাবে সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠছে।

সুমনের শেষ অস্ফুট আর্তনাদ কেউ শুনতে পেল না। ও শুধু অবাক বিস্ময়ে দেখল, সেই ছেলেটা – সেই কালকের ছেলেটা – হাসি হাসি মুখে ওর দিকে এগিয়ে এল, তার বিশাল নোংরা হাতটা দিয়ে সুমনের মুখটা চেপে ধরল, এক হাতে তুলে নিল ওর মাথাটা, আর সেই অসহ্য আওয়াজটাকে থামিয়ে ওর মাথাটাকে নিজের কানের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল “হ্যালো!”।